কিশোর গ্যাং- ভয়ংকর ভবিষ্যতের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা!

দেশজুড়ে নগরকেন্দ্রিক গ্যাং কালচার ভয়ংকর আকার ধারণ করেছে। মাদক নেশায় জড়িয়ে পড়া থেকে শুরু করে চুরি, ছিনতাই, ইভটিজিং, মাদক ব্যবসা, এমনকি নিজেদের অভ্যন্তরীণ বা অন্য গ্যাং গ্রুপের সঙ্গে তুচ্ছ বিরোধকে কেন্দ্র করে খুনখারাবি থেকেও পিছপা হচ্ছে না কিশোর অপরাধীরা।

দেশে বিরজমান এখনকার কিশোর গ্রুপ কিশোর গ্যাং ও দ্রুতলয়ে বেড়ে যাওয়া কিশোর অপরাধ সম্পর্কে গুণীজনদের মূল্যবান অনেক কথাই পত্রপত্রিকায় আসছে। কেউ কেউ বলছেন, এতে ইন্টারনেট প্রযুক্তির প্রসারের প্রভাব রয়েছে। কেউ বলছেন, পারিবারিক বন্ধন শিথিল, মা-বাবার সঙ্গে কিশোর সন্তানদের দূরত্ব তৈরি এবং খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড কমে যাওয়া ইত্যাদি কারণে শিশুদের মধ্যে নেতিবাচক প্রবণতা বাড়ছে, যা কিশোরদের ভ্রান্তপথে যাওয়ার একটি কারণ। অনেকের মতে, আমাদের সমাজে সন্ত্রাস ও খুন হরহামেশায় হচ্ছে এবং অর্থের বলে ও ক্ষমতার দাপটে সন্ত্রাসী ও খুনিরা বিচার ব্যবস্থাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সমাজে বহাল তবিয়তে অবস্থান করছে। তাদের সামাজিক মর্যাদা আরও বাড়ছে। কিশোররা এসব দেখে ধরে নিচ্ছে সন্ত্রাস করে পার পেয়ে যাওয়া তাদের পক্ষেও সম্ভব। তারা হয়ে উঠছে বেপরোয়া।

সমাজের প্রতিটা স্তরে নীতি নৈতিকতার অবক্ষয় হচ্ছে৷ ফলে সমাজ থেকে শিশুরা যা দেখছে তাই শিখছে। সমাজে সর্বস্তরে অপরাধ বাড়ছে তাই কিশোর অপরাধও বাড়ছে।

এই অবস্থা  থেকে প্রতিকারের উপায় কী? 

বাংলাদেশে দু’টি কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র আছে। একটি গাজিপুরের টঙ্গিতে অন্যটি যশোরে। ২০১৩ সালের শিশু আইন অনুযায়ী ৯ থেকে অনূর্ধ্ব ১৮ বছরের কোন শিশু অপরাধে জড়ালে তাদের সাধারণ কারাগারে না পাঠিয়ে বড়দের মতো শাস্তি না দিয়ে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয় এবং তাদের মানসিকভাবে শোধন করার ব্যবস্থা করা হয়।

এই শোধন প্রক্রিয়াই কি দেশের কিশোর গ্যাং অপরাধ নিধন করতে পারবে? সম্ভবনা খুবই ক্ষীণ। তবে কি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এভাবেই ধ্বংস হয়ে যাবে? না, এর লাগাম টেনে ধরার জন্যে যা যা প্রয়োজন এখনই তাই তাই করতে হবে। প্রথমত এখনই সচেতন হতে হবে অভিভাবকদের। দ্বিতীয়ত কেন কিশোর গ্রুপ কিশোর গ্যাং সৃষ্টি হচ্ছে এবং কেন আমাদের কিশোরদের মধ্যে ড্রাগ আসক্তি-খুন-ধর্ষণের মতো হিংস্র ও বিকৃত অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে, তার কারণ উদ্ঘাতন করতে হবে। এর জন্য দরকার অনেক বড় পরিসরে গবেষণা। আর সেই গবেষণালব্ধ তথ্যের ওপর ভিত্তি করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া। সরকারিভাবে অগ্রধিকারভিত্তিতে এ ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে।

সবশেষে যে কথাটি বলতে চাই, তা হলো, জন প্রতিনিধিরা যদি এগিয়ে আসেন, তাদের নিজ নিজ এলাকায় কিশোর গ্যাং অপরাধ বন্ধ করবেন এবং কিশোরদের কল্যাণকর কাজে উদ্বুদ্ধ করবেন, তাহলে এই সমস্যার সমাধান খুব সহজ হয়ে যায়। এর জন্য সমাজ সংস্কারক ও সরকারকে এগিয়ে আসা প্রয়োজন।

যে কৈশোর দশ বছর থেকে শুরু হয়, সেই বয়স এখন আমাদের কাছে আতঙ্ক! পত্রিকার পাতা থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, গলির মোড় থেকে চায়ের দোকান, গণপরিবহন থেকে টকশো-সব জায়গায় ‘কিশোর গ্যাং’ বা ‘গ্যাং কালচার’ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।

আপনারা আমাদের জন্য কী করেছেন? সব পত্রপত্রিকায় খালি একই ধরনের শিরোনাম। ‘কিশোর গ্যাং বাড়ছে’, ‘মাদকে আচ্ছন্ন কিশোর গ্যাং’, ‘গ্যাং কালচারে নষ্ট হচ্ছে সমাজ’, ‘ঢাকায় ৫০টি কিশোর গ্যাং সক্রিয়’ ইত্যাদি। কেন এইসব কিশোর গ্যাং বাড়ছে, তা কি আপনারা খুঁজে বের করেছেন? জনসংখ্যার হিসাবে যেখানে ঢাকায় প্রায় ১ হাজার ৩০০ খেলার মাঠ থাকার কথা ছিল, সেখানে দুই সিটি করপোরেশনে আছে মাত্র ২৩৫টি খেলার মাঠ, অর্থাৎ মাঠের ঘাটতি প্রায় ১ হাজার ১০০। তাহলে ছেলেমেয়েরা যাবে কোথায়? খেলার মাঠ নেই, পাঠাগার নেই, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নেই কোথাও। শুধু পড়াশোনার কথা বলে কিশোরদের আটকে রাখতে পারবেন? যেসব স্কুলে আমরা পড়াশোনা করি, সেসব স্কুলের বেশিরভাগেরই কোনও মাঠ নেই। তাহলে আমরা কোথায় খেলবো? একটি বাচ্চা অসৎ পথে যাওয়ার পেছনে তার অভিভাবকের দায় অবশ্যই আছে, এটি আমরা কোনোভাবেই অস্বীকার করি না। কিন্তু সে বাচ্চা যে মাঠে খেলতে পারছে না, পাঠাগারে যেতে পারছে না, কোথাও তার আড্ডার জায়গা নেই, তা কেউ বলছে? বলছে না। একজন কিশোর পড়াশোনার বাইরে বাকি সময়টা কী করবে? স্কুলে যা আছে, তা হলো প্রতিযোগিতা। কে কার চেয়ে কত ভালো করছে, কে কার চেয়ে কত ভালো করবে—এই প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতার মানসিকতায় আমরা ক্লান্ত।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার দুই সিটিতে মাঠ আছে ২৩৫টি। কিন্তু এই মাঠগুলোর মধ্যে মাত্র ৪২টি মাঠে আছে সাধারণের প্রবেশ অধিকার। প্রতিষ্ঠানের অধিকারে মাঠ দখলে আছে ১৪১টি আর কলোনির মাঠ আছে ২৪টি, যা ওই নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা কলোনির মানুষদের জন্য সংরক্ষিত। এর বাইরে ঈদগাহ মাঠ আছে ১২টি, যেখানে সুযোগ আছে খেলাধুলা করার। আর ১৬টি মাঠ দখল করে আছে কোনও না কোন সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক বা সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান।

এই যদি হয় শুধু একটি সিটি করপোরেশনের অবস্থা, তাহলে বাকিগুলোর কী অবস্থা? শুধু মাঠ নয়, পাঠাগারের অবস্থা আরও করুণ। একসময় ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকায় ২৩টি পাঠাগার ছিল। বর্তমানে তা কমতে কমতে সাতটিতে এসে ঠেকেছে। এই সাতটিও নিয়মিত খোলা হয় না। নতুন বই কেনা হয় না বহুদিন।

শুধু ঢাকা সিটির পাঠাগারের যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে বাকি সিটি করপোরেশনের পাঠাগারগুলোর কী অবস্থা? যে প্রশ্ন নিয়ে আমি কিশোরদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলেম সেই প্রশ্নের উত্তর তো আমি নিজেই পেয়ে যাচ্ছি। একজন কিশোর যদি কোথাও তার অবসর ফলপ্রসূভাবে কাটাতে না পারে, সে তো মোবাইলের মাধ্যমে ফেসবুক গ্রুপ বা গ্যাং কালচারের সঙ্গে জড়িত হবে, এইটাই স্বাভাবিক।

আমরা সবাই বলছি ‘কিশোর গ্যাং’র অপরাধের কথা। তাদের বখে যাওয়ার কথা। কিন্তু কেন একজন কিশোর বখে যাচ্ছে, এটি আমরা ক’জন ভাবছি? কিশোরদের অপরাধ প্রবণতা বাড়ার আরেকটি কারণ হলো, সমাজের অন্য সব অপরাধের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়া। আমরা বারে বারে বলছি মানুষের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ কমে গেছে। কিন্তু কেন কমেছে? মানবিক মূল্যবোধ হঠাৎ করে কমে গেছে বিষয়টা তাও নয়। প্রতিটি ঘটনা ঘটার পেছনে অনেক ছোট ছোট ঘটনা দীর্ঘসময় ধরে ঘটতে থাকে। একদিনে কিশোর অপরাধ বড় আকার ধারণ করেনি। যে সমাজে ধর্ষণের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয় না, ইভটিভিং-এর শাস্তি হয় না, মাদক সম্রাট দেশদরদি আখ্যা পায় সেই সমাজে অপরাধ বাড়বেই এইটা স্বাভাবিক। এটি আমার কথা নয়। এটি নিউটনের তৃতীয় সূত্র‘-প্রত্যেকটি ক্রিয়ারই সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে।’ সেই সূত্র অনুযায়ী কিশোররা এসব দেখছে, জানছে। তারাও ভাবছে, এখানে অপরাধ করলে শাস্তি হয় না। এটা ভেবে তারাও অপরাধে জেনে অথবা না জেনে জড়িয়ে পড়ছে।

আরেকটি বিষয় সবচেয়ে শঙ্কার, তা হলো কিশোরদের সংশোধনাগার। যেসব কিশোরের সংশোধনাগারে নেওয়া হচ্ছে, তাদের জন্য কি সঠিক ব্যবস্থাপনা আছে? বিষয়টা যেন এমন না হয়, একজন কিশোর সংশোধনাগার থেকে বেরিয়ে এসে আরও খারাপ অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এই বিষয় নিয়ে আমাদের সবারই ভাবতে হবে।

কিশোর গ্যাং থেকে ফিরিয়ে এনে কিশোরদের শক্তিতে রূপান্তর করা সম্ভব। এরজন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার পাশাপাশি আমাদের সদিচ্ছারও প্রয়োজন। ঘর থেকে শুরু করে স্কুল, কলেজ সব জায়গায় কিশোরদের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে কর্মপরিকল্পনা সাজাতে হবে। ফুটবল, ক্রিকেট খেলা থেকে শুরু করে গান-নাচ-বাদ্যযন্ত্র শেখানো, আবৃত্তি, গল্প শোনা, গল্প বলা, গল্প বানানো, শব্দের খেলা, ছবি জোড়া দেওয়া, শারীরিক শিক্ষাসহ বিভিন্ন কার্যক্রমের মধ্যে তাদের ব্যস্ত রাখতে হবে। প্রতিযোগিতা নয়, তারা কতটা সৃজনশীলভাবে তা শিখতে পেরেছে তা দেখা প্রয়োজন।

শিশু-কিশোরদের মোবাইল হাতে না দিয়ে বই পড়ায় উৎসাহী করে তুলতে হবে। তাদের নিয়েই মঞ্চনাটক, পথনাটকসহ সব সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বাড়াতে হবে।

যদি একটি শিশু, শিশু বয়স থেকে নারীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, খেলাধূলা, থিয়েটার, সংগীত, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডসহ বিভিন্ন কার্যক্রমে জড়িত থাকে, যদি তার মনস্তাত্ত্বিক জায়গা বুঝে তাকে গড়ে তোলা হয়, তবে তার কৈশোর ভালো কাটবে, আর কৈশোর ভালো কাটলে তার তারুণ্য হবে সবচেয়ে ফলপ্রসূ। এভাবে সুদীর্ঘ পরিকল্পনার মধ্যদিয়ে কিশোরদের আলাদা করে গড়ে তুলতে হবে, তবেই কিশোর অপরাধ কমে যাবে। না হয় উত্তপ্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়বে যেখানে, সেখানে আর আমাদের কিশোরদের শক্তি হারিয়ে যাবে অতলে।

Post a Comment

Previous Post Next Post